অনন্ত রজনী

কষ্ট (জুন ২০১১)

Rajib Ferdous
  • ২৫
  • 0
বেতনটা হাতে পেতেই এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় রজনীর মনটা ভরে উঠলো। কথা ছিল প্রতি মাসের দশ তারিখের মধ্যেই বেতন পরিশোধ করা হবে। এরা কথা রেখেছে। রজনী অবশ্য একটু ভয়ে ভয়ে ছিল। কারণ, মা আর ছোট বোন অণুকে নিয়ে সে আরাম বাগের যে ছোট্ট বাসাটিতে উঠেছে সেটির ভাড়া দশ তারিখের মধ্যেই দিতে হবে। বাড়িওয়ালা কথাটি কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়েছে। অফিস আজ তাকে বেতন না দিলে সে মহাবিপদে পড়ে যেত। যাইহোক, এখন সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। নিজের অফিস রুমটিতে গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়লো সে। সামনের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো একবার। প্রায় আটটা বেজে গেছে। তার মানে অফিস টাইম শেষ। কোন কাজও অবশ্য তার নেই। তবুও কেন জানি তার অফিস ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছেনা। বরং ভালই লাগছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, আরো কিছুক্ষণ অফিসে থেকে তারপর বাসার দিকে রওনা হবে।
রজনী আয়েশে চোখ বন্ধ করলো। আজ তার প্রথম উপার্জনের সাথে যে কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাল লাগাই জড়িয়ে আছে তাই নয়, রয়েছে কিছু দায়িত্বও। মাকে একজন ভাল চোখের ডাক্তার দেখিয়ে চশমা দিতে হবে। গত কয়েকমাস ধরে একেবারেই চোখে ঝাপসা দেখছেন। দুই হাত দুরের রজনীকেও তিনি ভাল দেখতে পান না। অথচ তিনি তা রজনীকে বুঝতে দেন না। বুঝতে দিলেই তো সমস্যা। মেয়েটা ডাক্তার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। প্রয়োজন হবে অনেক টাকার। এত টাকা পাবে কোথায় ও? টাকার জন্য তো ওর বিয়েটাই হচ্ছেনা। কালো মেয়ে। যেই দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যে দু'একজন রাজি থাকলেও তাদের আবার চাহিদা বিশাল। তাদের সেই চাহিদা পূরণের কিঞ্চিত সামর্থ্যর রজনীদের নেই।
শুধু যে মা-ই রজনীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে তা-ই নয়, ছোট বোন অণুও তার কাছে অনেক বিষয় চেপে যায়। চেপে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন রাতে অণু তাকে বলেছিল, 'জানিস আপু, রোদের ভিতর হেঁটে হেঁটে কলেজে যাওয়ার পর গা ঘেমে বিশ্রী গন্ধ বের হয়। ক্লাসে সবার সঙ্গে বসতে কেমন অস্বস্তি লাগে।'
রজনী বলেছিল, 'তোর একটা ভাল পারফিউম লাগবে, এই তো?'
অণু একটু মন খারাপ করে বলেছিল, 'আমি তো তা বলিনি আপু। তাছাড়া........'
অণুকে আর বলতে দেয়নি রজনী। কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিল, 'তাছাড়া এখনতো মামা আর আমাদের চালাচ্ছে না যে আমরা আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছা চেপে যাব, ছোট ছোট স্বপ্ন দেখবো না। তা হবে কেন? আমি চাকরি করছিনা? আমার বেতন অনেক। প্রথম মাসের বেতন পেয়েই তোর পারফিউম কিনবো অবশ্যই।'
অফিসের চেয়ারে চোখ বুজে বসে থেকেই রজনী সিদ্ধান্ত নেয়, আজ বাসায় ফেরার সময় অণুর জন্য একটি পারফিউম কিনে নেবে আর কালকেই মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।
আরও কিছুৰণ বসে থেকে রজনী যখন অফিস থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আসার সময় রজনী দেখলো একাউন্ট্যান্ট সফিক সাহেব শেষ বারের মত হিসাব নিকাশ মিলিয়ে নিচ্ছেন। সম্ভবত তিনিই সবার শেষে বের হন। রজনীকে দেখে তিনি মুচকি হেসে বললেন, 'চলে যাচ্ছেন বুঝি? তা সাবধানে যাবেন। যা দিনকাল পড়ছে।'
উত্তরে রজনী কেবল মুচকি হেসে তাকে একটি ধন্যবাদ দিল। সফিক সাহেব কাজে মন দিলেন।
রাস্তায় বের হয়ে রজনীর অন্যরকম লাগে আজ। মনে হয় অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের রাতের ঢাকা একটু বেশিই ঝলমল করছে। চারপাশের বাড়ি ফেরা ব্যস্ত মানুষের ছুটাছুটি আর রিক্সা-গাড়ির বহর আজ তাকে মোটেও বিচলিত করেনা। বরং সবকিছুতেই একটা ভাল লাগার আবেশ ছুঁয়ে যায় তার মনে।
মতিঝিলের এক দোকান থেকে অণুর জন্য নামী ব্রান্ডের একটি পারফিউম কিনে রিক্সায় উঠে রজনী। কোলের উপর তার সাইড ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখে এক হাতে। অন্য হাতে ঝুলিয়ে রাখে পারফিউমের ছোট্ট সুদৃশ্য ব্যাগের হাতল দুটি।
একটু পরেই মুল রাস্তা থেকে রিক্সা গলিতে ঢুকে পড়ে। কিছুদূর যেতেই চারদিক অন্ধকার করে কারেন্ট চলে যায়। যেটা এই ঢাকা শহরের প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। অন্ধকারে চলতে গিয়ে রজনীর কেমন জানি একটু অস্বস্তি লাগে। অথচ প্রায়ই তাকে অন্ধকারেই বাসায় ফিরতে হয়। তারপরও আজ কেমন যেন মনের ভিতর একটু খচ্ খচ্ করে ওঠে। কই কখনো তো এ রাস্তায় তেমন কিছু ঘটেছে বলে সে শোনেনি।
নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে সে। গলির মাঝামাঝি জায়গাটা বেশ নির্জন মনে হয় তার কাছে। একটু সতর্কতার জন্য সে কোলের উপর রাখা সাইড ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। এই ব্যাগের ভিতর তার মার দৃষ্টি, বোনের ইচ্ছে পূরণ আর তাদের ছোট্ট সংসারের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো ঘাপটি মেরে আছে।
রজনী ভাবতে থাকে, বাসার কাছাকাছি নেমে কিসলু ভাইর দোকান থেকে মোমবাতি কিনে নিতে হবে। বাসায় মনে হয় মোম নেই। আজ বেশি করে কিনে নিলেই হবে। কিসলু ভাইর কাছে বাকিও পড়েছে অনেক। আজ সব দিয়ে দেবে। মানুষটাকে তার মন্দ মনে হয়না। অল্পদিনের পরিচয়েই বাকি দিতে রাজি হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে তাকে একা পেলে দু'একটা অশালীন বাক্য বলে। অন্য কিছু ইঙ্গিত করতে চায়। রজনী হজম করে যায়। এই অভাবের সংসারে সারা মাস ধরে টুকটাক কিছু জিনিষ বাকি পাওয়া গেলে তাদের অনেক উপকার হয় বটে। তবে রজনী খোঁজ নিয়ে জেনেছে কিসলু ভাই বিবাহিত। একটি ছেলেও আছে। তাই আর সে আগ্রহ দেখায়নি।
এইসব যখন রজনী ভাবছিল, ঠিক তখনই কিছু বুঝে ওঠার আগেই রজনীর ভাবনার পৃথিবীটা প্রচণ্ড রকমভাবে দুলে ওঠে। একটি শক্ত পেশীবহুল হাত চিলের মত ছোঁ দিয়ে তার কোল থেকে সাইড ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় রজনী হতবাক! পর মুহূর্তেই সে রিক্সা থেকে লাফিয়ে পড়ে। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। মানুষের জটলা বেঁধে যায় মুহূর্তেই। তাদের ভিতর থেকে কয়েকজনের আফসোস বাক্য শোনা যায় অস্পষ্টভাবে।
ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত আর অসহায় এক মন নিয়ে রজনী বাসায় ফেরে। টের পেয়ে অন্ধকারে মা চেঁচিয়ে ওঠে, 'রজো, মা তুই এলি?'
রজনী কোন উত্তর দেয়না। অণু রজনীর পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলতে থাকে, 'কি যে ছাই একটাও মোমবাতি নেই ঘরে। কারেন্টও.......' বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় অণু। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলে, 'আপু, ঘরে এত সৌরভ কিসের? তুমি কি পাচ্ছনা?'
রজনী বুঝতে পারছেনা কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে। আসলেই তো। ঘরের ভিতর এত সৌরভ কিসের? অণুর জন্য কেনা পারফিউমের সৌরভটাও তো অবিকল এরকমই ছিল। রজনীর বুকটা হু হু করে ওঠে। সে ধরা গলায় বলে, 'মা আমাকে তুমি কি একটু জড়িয়ে ধরবে?'
মা বুঝতে পারেন মেয়ের কিছু একটা হয়েছে। অন্ধকারে তিনি রজনীকে খুঁজে পেতে ব্যাকুল হয়ে হাতরাতে থাকেন। রজনীর চোখ বেয়ে বয়ে যায় জলের ধারা। তখনো কারেন্ট আসেনি। রজনী মনেপ্রাণে চাইল কারেন্ট যেন আর কোনদিনও না আসে। অন্ধকারে ডুবে যাক তার পৃথিবী। সে তার চোখের জল কাউকেই দেখাতে চায়না। মাকেও না, অণুকেও না। কাউকে না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রওশন জাহান আপনার কথার সুত্র ধরেই বলছি , ছোট গল্পে একটা চমক থাকতে হয় শেষে .এখানে তা পেলাম না. মাঝখান থেকেই মনে হচ্ছিল টাকাটা ছিনতাই হবে. আর কাহিনী বিন্যাস খুব সাদামাটা . আপনার কাছ থেকে আরো ভালো লেখা আশা করি.
Shahnaj Akter N/A সফিক সাহেব যখন রজনী কে বললেন সাবধানে যাবেন , তখনি বুঝেছিলাম টাকা টা ছিনতাই হবে , খুব সাদামাটা সাধারণ গল্প .....তবে আপনার জলকাব্য , তুলনাহীন ...........
অদিতি গল্প ভাল লাগল
Md. Akhteruzzaman N/A নতুন করে আর কিছু বলছি না| যা বলার আপনার অন্য গল্পটা পড়ে আগেই বলে দিয়েছি| অনেক অনেক শুভ কামনা|
এস, এম, ফজলুল হাসান N/A ভাই ছিনতাইকারী রজনীর প্রথম মাসের বেতনটাই নিয়ে গেল ! খুব কষ্ট পেলাম গল্পটা পড়ে
রাজিয়া সুলতানা অনেক সাধারণ ঘটনাই,অসাধারণ হয়ে ওঠে লেখকের লেখার কৃতিত্বে ......এই গল্পটাই তা আবার প্রমান করলো.....অনেক শুভকামনা........
সূর্য N/A রজনীর বাসাভাড়াটা কি পরিশোধ করা হয়েছিল? দোকান বাকি? মায়ের চোখের ডাক্তার? গল্পটা আসলে খুব কষ্ট দিয়েছে...................... ভালই লিখেছ
আবু ফয়সাল আহমেদ প্রথম ৭ লাইন শেষে বুঝতে পারলাম গল্পের শেষটা কি. মানে হলো ওই খানেই গল্পটার মৃত্যু হলো. ছোট গল্পের চমক তো শেষে! এটা যদি আগেই শেষ হয়ে যায় তাহলে কিভাবে হবে?
মিজানুর রহমান রানা রজনী মনেপ্রাণে চাইল কারেন্ট যেন আর কোনদিনও না আসে। অন্ধকারে ডুবে যাক তার পৃথিবী। সে তার চোখের জল কাউকেই দেখাতে চায়না। ------অপূর্ব।

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পদত্যাগ”
কবিতার বিষয় "পদত্যাগ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫